ঠাকুরগাঁও বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটি জেলা। এটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪৬৭ কিলোমিটার দূরে। এটির দক্ষিণে দিনাজপুর জেলা, পূর্বে পঞ্চগড় জেলা এবং এর পশ্চিম ও উত্তর দিকে ভারত বেষ্টিত এটি হিমালয়ের সমতল ভূমির একটি অংশ। ঠাকুরগাঁও ১৮৬০ সালে ঠাকুরগাঁও সদর, বালিয়াডাঙ্গী, পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল, হরিপুর ও রুহিয়া নামে ৬টি থানার সমন্বয়ে একটি মহাকুমা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৪৭ সালে এটি জলপাইগুড়ির ৩টি থানা এবং ভারতের কোচবিহারের একটি থানা সহ একটি মহাকুমা হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮১ সালে আটোয়ারীকে নতুন পঞ্চগড় জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এলাকাটি মাত্র ৫টি থানার মধ্যে সংকুচিত হয়। তারপর ১ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ সালে এটি একটি জেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঠাকুরগাঁও মূলত কৃষিপ্রধান জেলা। জেলায় উৎপাদিত প্রধান ফসল হল ধান, গম, ভুট্টা, পাট ও আলু। এছাড়াও জেলাটিতে বেশ কয়েকটি চা বাগান রয়েছে। জেলার পর্যটন আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে ঠাকুরগাঁও কেল্লা, রানীশংকৈল রাজবাড়ী, হরিপুর উপজেলা পার্ক এবং বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা উদ্যান।
ঠাকুরগাঁও নামকরণ ও জেলার ইতিহাস
ঠাকুরগাঁও জেলার নামকরণ করা হয়েছিল বরুণ ঠাকুর একজন মৈথিল ব্রাহ্মণ যিনি অষ্টাদশ শতকে এই অঞ্চল শাসন করেছিলেন। ১৮৭৯ সালের আগে ঠাকুরগাঁও বিকাশ ঝা, বরুণ ঠাকুর এবং বিধানেশ রায় সহ বিভিন্ন হিন্দু জমিদার দ্বারা শাসিত ছিল। ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঠাকুরগাঁওয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং সেখানে একটি তহসিল (একটি জেলা মহকুমা) প্রতিষ্ঠা করে। তহসিলটি প্রাথমিকভাবে দিনাজপুর জেলার অংশ ছিল কিন্তু ১৯৮৪ সালে এটি দিনাজপুর থেকে পৃথক হয়ে একটি পৃথক জেলায় পরিণত হয়।
বর্তমানে ঠাকুরগাঁও বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের একটি জেলা। এটি দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এবং পশ্চিমে ভারতের সীমান্ত রয়েছে।
ঠাকুরগাঁও জেলার উপজেলা/থানা সমূহ
ঠাকুরগাঁও জেলায় ৫টি থানা বা উপজেলা রয়েছে। যা হল:
- ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা,
- বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা,
- পীরগঞ্জ উপজেলা,
- রানীশংকৈল উপজেলা,
- হরিপুর উপজেলা।
ঠাকুরগাঁও জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ
বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলার কিছু পর্যটন/দর্শনীয় স্থান গুলোর মধে রয়েছে:
কান্তনগর মন্দির
ষোড়শ শতাব্দীর এই মন্দিরটি ঠাকুরগাঁওয়ের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ। এটি একটি হিন্দু মন্দির যা দেবী কালীকে নিবেদিত। এটি ঠাকুরগাঁও জেলার মোদেরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত।
টাঙ্গন নদী
টাঙ্গন নদী ঠাকুরগাঁও জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি বড় নদী। নদীটি বোটিং, মাছ ধরা এবং সাঁতারের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। এটি মাছ, পাখি এবং কুমির সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।
রানীশংকৈল রাজবাড়ী
১৯ শতকের এই প্রাসাদটি রানীশঙ্কর রায় পরিবারের সাবেক বাসভবন। প্রাসাদটি ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলায় অবস্থিত এটি এখন একটি জাদুঘর যেখানে রায় পরিবারের নিদর্শন এবং ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস প্রদর্শিত হয়।
গোর্খাই হেরিটেজ
এই ঐতিহ্যবাহী স্থানটি ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলায় অবস্থিত। এটি একটি মসজিদ একটি মন্দির এবং একটি জলকল সহ পুরানো ভবনগুলির একটি সংগ্রহ। এটি ইতিহাস উৎসাহিত এবং ফটোগ্রাফারদের জন্য একটি জনপ্রিয় জায়গা।
রামরাই দিঘী
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলায় এই পুকুরটি অবস্থিত। এটি বোটিং, মাছ ধরা এবং সাঁতারের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। এছাড়াও পুকুরটি মাছ, পাখি এবং কচ্ছপ সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।
প্রেমবাগান
ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলায় এই বাগানটি অবস্থিত। এটি পিকনিক, ঘোরাঘুরি এবং পাখি দেখার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। বাগানটি বিভিন্ন ফুল, গাছপালা এবং গাছের আবাসস্থল।
বোলাকা উদ্যান
ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলায় এই জাতীয় উদ্যানটি অবস্থিত। এটি পাখি পর্যবেক্ষন, হাইকিং এবং ক্যাম্পিং এর জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। পার্কটি পাখি, হরিণ এবং বানর সহ বিভিন্ন ধরণের বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।
ঠাকুরগাঁও জেলার পাবলিক পার্ক সমূহ
ঠাকুরগাঁও জেলার কিছু পাবলিক পার্ক গুলোর মধ্যে রয়েছে:
ডিসি ট্যুরিজম পার্ক
ঠাকুরগাঁও শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই পার্কটি স্থানীয় ও পর্যটকদের কাছে একইভাবে একটি জনপ্রিয় স্থান। এটিতে একটি হ্রদ, একটি খেলার মাঠ, একটি চিড়িয়াখানা এবং বেশ কয়েকটি রেস্তোঁরা এবং দোকান সহ বিভিন্ন ধরণের আকর্ষণ রয়েছে৷
প্রেম রোড
এই রাস্তাটি গাছ এবং ফুলের সাথে সারিবদ্ধ, এটিকে হাঁটার জন্য বা সাইকেল চালানোর জন্য একটি মনোরম জায়গা করে তোলে। এটি বেশ কয়েকটি ছোট দোকান ও রেস্তোরাঁর আবাসস্থল।
টিজিসি পার্ক
এই পার্কটি ঠাকুরগাঁও শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত এবং এটি পিকনিক ও পারিবারিক বেড়াতে যাওয়ার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। এটিতে একটি বড় খেলার মাঠ, একটি হ্রদ ও বেশ কয়েকটি খোলা জায়গা রয়েছে।
যে কারনে ঠাকুরগাঁও জেলা বিখ্যাত
ঠাকুরগাঁও জেলা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, তার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং তার বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষদের জন্য বিখ্যাত। জেলাটি বিখ্যাত হওয়ার মধ্যে কয়েকটি এখানে রয়েছে:
- প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: ঠাকুরগাঁও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ও এটি তার সবুজ পাহাড় তার ঘূর্ণিঝড় নদী এবং এর সুন্দর বনের জন্য পরিচিত। এছাড়াও জেলাটিতে দুধকুমার বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ফুলবাড়ি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য সহ বেশ কয়েকটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রয়েছে।
- সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি: ঠাকুরগাঁওয়ের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সংস্কৃতি রয়েছে যা বহু শতাব্দী আগের। জেলাটি হরিপুর দুর্গ এবং রানীশংকৈল প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ সহ অনেক ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষের আবাসস্থল। ঠাকুরগাঁও বার্ষিক রামরাই মেলা ও বার্ষিক গোরোক্ষনাথ মেলা সহ বেশ কয়েকটি উৎসবের আবাসস্থল।
- বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষ: ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষ তাদের আতিথেয়তা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের জন্য পরিচিত। ঠাকুরগাঁওয়ের দর্শনার্থীদের সর্বদা খোলা বাহু দিয়ে স্বাগত জানানো হয় ও তাদের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করা হয়।
বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার জন্য ঠাকুরগাঁও জেলাটি একটি চমৎকার জায়গা।