মানিকগঞ্জ বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের একটি জেলা যা ঢাকা বিভাগে অবস্থিত। এর উত্তরে গাজীপুর জেলা, পূর্বে মুন্সীগঞ্জ, দক্ষিণে ফরিদপুর এবং পশ্চিমে নরসিংদী জেলাগুলো রয়েছে। জেলার মোট আয়তন প্রায় ১,৩৮৪ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ১.৫ মিলিয়নেরও বেশি। এর জেলা সদর মানিকগঞ্জ শহরে অবস্থিত।
মানিকগঞ্জ একটি উর্বর কৃষি জেলা যার প্রধান ফসল হল ধান। জেলাটিতে টেক্সটাইল, সিরামিক এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সহ বেশ কয়েকটি শিল্পের আবাসস্থল। সোমপুরা মহাবিহারে বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ, হযরত শাহ মখদুম শাহের মাজার এবং হযরত শাহ জালালের সমাধিসহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থান সহ মানিকগঞ্জ একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।
মানিকগঞ্জ নামকরণ ও জেলার ইতিহাস
মানিকগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস দীর্ঘ ও জটিল। মানিক শাহ নামে একজন সুফি সাধকের নামানুসারে জেলার নামকরণ করা হয়েছিল যিনি ১২ শতকে এই এলাকায় বসবাস করতেন বলে জানা যায়। যাইহোক, মানিকগঞ্জ নামটিও সংস্কৃত শব্দ "মাণিক্য", যার অর্থ "রত্ন" থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়। এটি সম্ভবত কারণ এলাকাটি তার বহু মূল্যবান পাথরের জন্য পরিচিত।
১৮৪৫ সালে মানিকগঞ্জকে ঢাকা জেলার একটি মহকুমা ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এটি একটি মহকুমা ছিল, যখন এটি একটি পূর্ণ জেলার মর্যাদায় উন্নীত হয়। এটি মানিকগঞ্জ কেল্লা, মানিকগঞ্জ জাদুঘর এবং মানিকগঞ্জ মসজিদ সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থানের আবাসস্থল।
মানিকগঞ্জ নামটি একটি সমৃদ্ধ এবং জটিল নাম যা জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করে। এটি একটি নাম যা প্রাচীন এবং আধুনিক উভয়ই, এবং এটি এমন একটি নাম যা নিশ্চিতভাবে বহু বছর ধরে ব্যবহার করা হবে।
মানিকগঞ্জ জেলার উপজেলা/থানা সমূহ
মানিকগঞ্জ জেলায় ৭টি থানা/উপজেলা রয়েছে, যা হল:
- মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা,
- সিংগাইর উপজেলা,
- দৌলতপুর উপজেলা,
- সাটুরিয়া উপজেলা,
- ঘিওর উপজেলা,
- শিবালয় উপজেলা,
- হরিরামপুর উপজেলা।
উপজেলাগুলিকে আবার ইউনিয়ন পরিষদে এবং গ্রামে বিভক্ত করা হয়েছে।
মানিকগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ
মানিকগঞ্জ জেলার কিছু পর্যটন/দর্শনযোগ্য স্থান এখানে দেওয়া হল:
বালিয়াটি প্রাসাদ
এটি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বালিয়াটি গ্রামে অবস্থিত একটি বিশাল প্রাসাদ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বালিয়াটির জমিদাররা এটি নির্মাণ করেন। প্রাসাদটি বাঙালি স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন। এতে একটি বড় উঠোন, বেশ কয়েকটি কক্ষ এবং একটি বাগান রয়েছে।
তেওতা জমিদার প্রাসাদ
এটি সিংগাইর উপজেলার তেওতা গ্রামে অবস্থিত আরেকটি বড় প্রাসাদ। এটি ১৮ শতকে তেওতার জমিদাররা তৈরি করেছিলেন। প্রাসাদটি মুঘল স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন। এটির একটি বড় উঠোন, বেশ কয়েকটি কক্ষ এবং একটি বাগান রয়েছে।
নাহার বাগান
সাটুরিয়া উপজেলার কামতা গ্রামে অবস্থিত একটি সুন্দর বাগান এটি। এটি ১৯ শতকে সাটুরিয়ার জমিদারদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। বাগানে রয়েছে বেশ কিছু পুকুর, ঝর্ণা এবং বিভিন্ন ধরনের ফুল ও গাছ।
মটর মথ
এটি সাটুরিয়া উপজেলায় অবস্থিত একটি বড় বটগাছ। এটি ১০০০ বছরের বেশি পুরানো বলে জানা গেছে। গাছটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং মানিকগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি স্মারক।
হাজারী গুড়
এটি সাটুরিয়া উপজেলায় অবস্থিত একটি বিশাল মাটির ঢিবি। বলা হয় এটি একটি বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ। ঢিবিটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান এবং মানিকগঞ্জের সমৃদ্ধ ইতিহাসের একটি স্মারক।
চরভাঙ্গা
এটি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় অবস্থিত একটি নদী। এটি বোটিং এবং মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। ডলফিন এবং কুমির সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলও এই নদী।
কানাইনগর
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় অবস্থিত একটি গ্রাম এটি। এটি পাখি দেখার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। গ্রামটি হেরন, এগ্রেট এবং সারস সহ বিভিন্ন ধরণের পাখির বাসস্থান।
কাশিমনগর
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় অবস্থিত একটি সীমান্ত শহর। এটি কেনাকাটা করার জন্য এবং ভারতে পাড়ি দেওয়ার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। কাশিমনগরে একটি দুর্গ এবং একটি মসজিদ সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ভবন রয়েছে।
মানিকগঞ্জ জেলার পাবলিক পার্ক সমূহ
এখানে মানিকগঞ্জ জেলার কিছু পাবলিক পার্ক রয়েছে:
আজম উদ্দিন পার্ক
মানিকগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই পার্কটি স্থানীয় এবং পর্যটকদের কাছে একইভাবে একটি জনপ্রিয় স্থান। এটিতে একটি বড় হ্রদ, একটি খেলার মাঠ, একটি মসজিদ এবং অন্যান্য অনেক সুযোগ সুবিধা রয়েছে৷
নীলক্ষেত পার্ক
এই পার্কটি পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত এবং নদী এবং আশেপাশের গ্রামাঞ্চলের অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখায়। এটি পিকনিক, বোটিং এবং মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।
সদর উদ্যান
মানিকগঞ্জের সদর উপজেলায় অবস্থিত এই পার্কটি পরিবার ও শিশুদের কাছে একটি জনপ্রিয় স্থান। এটিতে একটি খেলার মাঠ, একটি চিড়িয়াখানা এবং অন্যান্য অনেক সুযোগ সুবিধা রয়েছে৷
হাতিরঝিল পার্ক
এই পার্কটি মানিকগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত এবং পাখি দেখার এবং প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এটি একটি জনপ্রিয় স্থান। এটিতে একটি বড় হ্রদ, বেশ কয়েকটি হাঁটার পথ এবং অন্যান্য অনেক সুবিধা রয়েছে।
দীঘিপাড়া পার্ক
এই পার্কটি মানিকগঞ্জের দীঘিপালং উপজেলায় অবস্থিত এবং সাঁতার কাটা এবং নৌকা চালানোর জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। এটিতে একটি বড় হ্রদ, বেশ কয়েকটি হাঁটার পথ এবং অন্যান্য অনেক সুবিধা রয়েছে।
যে কারনে মানিকগঞ্জ জেলা বিখ্যাত
মানিকগঞ্জ জেলা বেশ কিছু জিনিসের জন্য বিখ্যাত, যার মধ্যে রয়েছে:
- হাজারী গুড়: মানিকগঞ্জ তার হাজারী গুড়ের জন্য সুপরিচিত এক প্রকার খেজুর চিনি যা জেলার ঝিটকা এলাকায় উৎপন্ন হয়। হাজারি গুড় তার বিশুদ্ধতা এবং গন্ধের জন্য পরিচিত এবং এটি বাঙালি মিষ্টি এবং মিষ্টান্নের একটি জনপ্রিয় উপাদান।
- তেওতা প্রাসাদ: তেওতা প্রাসাদ মানিকগঞ্জে অবস্থিত একটি ১৭শ শতাব্দীর প্রাসাদ। প্রাসাদটি মুঘলদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালভাবে সংরক্ষিত মুঘল কাঠামোগুলির মধ্যে একটি।
- পাটুরিয়া ঘাট: পাটুরিয়া ঘাট মানিকগঞ্জের পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত একটি নদী বন্দর। পাটুরিয়া ঘাট একটি প্রধান পরিবহন হাব, এবং বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণে সংযোগ করতে ফেরি দ্বারা ব্যবহৃত হয়।
- ঘিওর মিষ্টি: ঘিওর মিষ্টি হল এক ধরনের বাঙালি মিষ্টি যা মানিকগঞ্জের ঘিওর এলাকায় তৈরি করা হয়। ঘিওর সুইটমিট তার নরম টেক্সচার এবং সমৃদ্ধ স্বাদের জন্য পরিচিত।
- বালিয়াটি জমিদারি প্রাসাদ: বালিয়াটি জমিদারি প্রাসাদ মানিকগঞ্জে অবস্থিত ১৯ শতকের একটি প্রাসাদ। প্রাসাদটি ব্রিটিশদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, এবং এখন এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য।
এই আকর্ষণগুলি ছাড়াও, মানিকগঞ্জ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, এর সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং এর প্রাণবন্ত সংস্কৃতির জন্যও পরিচিত। জেলাটিতে মসজিদ, মন্দির এবং সমাধি সহ বহু ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। মানিকগঞ্জ বন, নদী এবং হ্রদ সহ অনেকগুলি প্রাকৃতিক আকর্ষণের আবাসস্থল।