সাতক্ষীরা জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি জেলা এবং এটি খুলনা বিভাগের অন্তর্গত। এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত বরাবর অবস্থিত। এটি আড়পাংগাছিয়া নদীর তীরে অবস্থিত। এই জেলার সর্ববৃহৎ শহর ও সদর দপ্তর সাতক্ষীরা।
সাতক্ষীরা জেলার আয়তন প্রায় ৩,৮১৭ বর্গ কিলোমিটার (১,৪৭৪ বর্গ মাইল)। এটির উত্তরে যশোর জেলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে খুলনা জেলা এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সীমান্ত রয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার জনসংখ্যা প্রায় ২.০৮ মিলিয়ন (২০১৩)। জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলিম, সঙ্গে একটি ছোট হিন্দু সংখ্যালঘু। সরকারি ভাষা বাংলা।
সাতক্ষীরা জেলার অর্থনীতি কৃষি, মাছ ধরা এবং পর্যটন নির্ভর। জেলায় উৎপাদিত প্রধান ফসল হল ধান, পাট এবং গম। এছাড়াও এই জেলায় বেশ কিছু চিংড়ির খামার রয়েছে। পর্যটন জেলার একটি ক্রমবর্ধমান শিল্প, যেখানে অনেক দর্শক সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন দেখতে আসেন। এ জেলায় অনেক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক আকর্ষণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, যা পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এছাড়াও জেলাটিতে বেশ কয়েকটি মন্দির, মসজিদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ভবন রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা একটি উন্নয়নশীল জেলা যেখানে দর্শনার্থীদের জন্য অনেক কিছু রয়েছে। জেলাটির একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সংস্কৃতি রয়েছে এবং এখানে অনেকগুলি প্রাকৃতিক আকর্ষণ রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলার ইতিহাস
সাতক্ষীরা জেলার ইতিহাস দীর্ঘ ও জটিল। এলাকাটি প্রথমে বৌদ্ধদের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল, যারা পরে হিন্দুরা অনুসরণ করেছিল। ১৩শ শতাব্দীতে মুসলমানদের আগমন ঘটে এবং তখন থেকেই এই জেলাটি প্রধানত মুসলিম। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সাতক্ষীরা জেলা ছিল একটি প্রধান রণক্ষেত্র। পাকিস্তানি সেনারা এই জেলায় অনেক নৃশংসতা চালায়, এবং বহু লোককে হত্যা করা হয়। যুদ্ধের পর, সাতক্ষীরা জেলা পুনর্গঠন শুরু করে এবং তখন থেকে এটি একটি সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হয়।
বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলা একটি প্রধান কৃষি অঞ্চল। জেলায় উৎপাদিত প্রধান ফসল হল ধান, পাট এবং গম। এছাড়াও জেলাটিতে টেক্সটাইল, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং চামড়াজাত পণ্য সহ বেশ কয়েকটি শিল্পের আবাসস্থল। সাতক্ষীরা জেলা একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এই জেলায় সুলতানপুর শাহী মসজিদ এবং কালীমাখালী মাজার সহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। এছাড়াও জেলাটি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন সহ বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক আকর্ষণের আবাসস্থল।
সাতক্ষীরা জেলার থানা/উপজেলা সমূহ
জেলাটিতে মোট ৭ টি থানা/উপজেলা রয়েছে, যা হলো:
- আশাশুনি উপজেলা,
- দেবহাটা উপজেলা,
- কলারোয়া উপজেলা,
- সাতক্ষীরা সদর উপজেলা,
- শ্যামনগর উপজেলা,
- তালা উপজেলা,
- কালিগঞ্জ উপজেলা।
সাতক্ষীরা জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ
এখানে সাতক্ষীরার কিছু জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ গুলো তুলে ধরা হলো:
সুন্দরবন
সুন্দরবন হল বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং বাঘ, হাতি এবং কুমির সহ বিভিন্ন ধরণের বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। পর্যটকরা নৌকায় বা পায়ে হেঁটে বন ঘুরে দেখতে পারেন।
মোজাফফর গার্ডেন চিড়িয়াখানা
মোজাফফর গার্ডেন চিড়িয়াখানা হল সিংহ, বাঘ, হাতি এবং বানর সহ বিভিন্ন প্রাণীর একটি ছোট চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানায় একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং একটি খেলার মাঠও রয়েছে।
জাহাজঘাটা নৌ দুর্গ
জাহাজঘাটা নৌ দুর্গ হল ১৭ শতকের একটি দুর্গ যা মুঘলদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। দুর্গটি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, কিন্তু এটি এখনও একটি চিত্তাকর্ষক দৃশ্য।
ঈশ্বরীপুর হাম্মাম খানা
ঈশ্বরীপুর হাম্মাম খানা হল ১৬ শতকের একটি তুর্কি বাথহাউস। বাথহাউসটি আজও ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ।
তেতুলিয়া জামে মসজিদ
তেতুলিয়া জামে মসজিদ ১৭ শতকের একটি মসজিদ যা বাংলাদেশের বৃহত্তম মসজিদগুলোর একটি। মসজিদটি মুঘল স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন।
সুলতানপুর শাহী মসজিদ
সুলতানপুর শাহী মসজিদ হল ষোড়শ শতাব্দীর একটি মসজিদ যা বাংলাদেশের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি। মসজিদটি বাঙালি স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন।
টেঙ্গা ঈশ্বরীপুর মসজিদ
টেঙ্গা ঈশ্বরীপুর মসজিদ ষোড়শ শতাব্দীর একটি মসজিদ যা বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর মসজিদগুলির মধ্যে একটি। মসজিদটি বাঙালি স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন।
সোনাবাড়িয়া মঠ ও মন্দির
সোনাবাড়িয়া মঠ ও মন্দির হল একটি হিন্দু মন্দির কমপ্লেক্স যা বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানগুলির মধ্যে একটি। মন্দির কমপ্লেক্সে সোনাবাড়িয়া মঠ সহ বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে, যা দেবী কালীকে উত্সর্গীকৃত।
গুনাকরকাটি মাজার
গুনাকরকাটি মাজার হল একটি মুসলিম মাজার যা সুফি সাধক গুনাকরকাটিকে উত্সর্গীকৃত। মাজারটি সারা বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে একটি জনপ্রিয় তীর্থস্থান।
সাতক্ষীরার বহু দর্শনীয় স্থানের মধ্যে এগুলো মাত্র কয়েকটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থান এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে সাতক্ষীরা ছুটি কাটাতে বা সপ্তাহান্তে ছুটি কাটাতে যাওয়ার জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা।
সাতক্ষীরা জেলার পার্ক সমূহ
সাতক্ষীরা জেলার পার্ক এর মধ্যে অন্যতম:
মোজাফ্ফর গার্ডেন পার্ক
এই পার্কটি বিভিন্ন গাছ এবং ফুলের আবাসস্থল এবং এটি পিকনিক এবং পারিবারিক ভ্রমণের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। এটি সাতক্ষীরা শহরে অবস্থিত এবং প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
সাতক্ষীরা জেলার অনেকগুলো পার্ক ও আকর্ষণের মধ্যে এগুলো মাত্র কয়েকটি। এর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে, সাতক্ষীরা একটি আরামদায়ক অবকাশ বা আনন্দ-ভরা দিনের জন্য ভ্রমণের জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা।
যে কারনে সাতক্ষীরা জেলা বিখ্যাত
সাতক্ষীরা জেলা বেশ কিছু জিনিসের জন্য বিখ্যাত, যার মধ্যে রয়েছে:
- সুন্দরবন: সাতক্ষীরা সুন্দরবনের একটি বড় অংশের আবাসস্থল, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। সুন্দরবন একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য।
- প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: সাতক্ষীরা নদী, খাল-বিল, বনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক আকর্ষণের একটি সুন্দর জেলা।
- বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষ: সাতক্ষীরার মানুষ তাদের আতিথেয়তা এবং উষ্ণতার জন্য পরিচিত।
- সুলতানপুর শাহী মসজিদ: সুলতানপুর শাহী মসজিদ একটি ৫০০ বছরের পুরানো মসজিদ যা সাতক্ষীরা জেলার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ। মসজিদটি লাল ইটের তৈরি এবং একটি সুন্দর নকশা রয়েছে।
- জাহাজঘাটা নৌ কেল্লা: জাহাজঘাটা নৌ কেল্লা রূপসা নদীর তীরে অবস্থিত ১৬ শতকের একটি দুর্গ। দুর্গটি পর্তুগিজদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং এই অঞ্চলে তাদের ব্যবসায়িক কার্যকলাপের জন্য একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
- বারো দুয়ারী: বারো দুয়ারী হল ১৭ শতকের একটি প্রাসাদ যা ঈশ্বরীপুর শহরে অবস্থিত। প্রাসাদটি মুঘলদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং বাংলার নবাবদের দ্বারা গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
আপনি যদি একটি সুন্দর এবং আকর্ষণীয় স্থান খুঁজছেন, সাতক্ষীরা জেলা একটি চমৎকার বিকল্প। এর সমৃদ্ধ ইতিহাস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষের সাথে, সাতক্ষীরা নিশ্চিতভাবে আপনার একটি স্থায়ী ছাপ রেখে যাবে।