নোয়াখালী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি জেলা, যা চট্টগ্রাম বিভাগে অবস্থিত। এটি ১৮২১ সালে জেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৬৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নোয়াখালীর নামকরণ করা হয়। এর সদর দফতর মাইজদী শহরে অবস্থিত যার ফলে নোয়াখালী বাংলাদেশের একমাত্র জেলা যা শহরের নামের নামে নামকরণ করা হয়নি। এর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে কুমিল্লা জেলা, উত্তর-পশ্চিমে ফেনী জেলা এবং পশ্চিমে চাঁদপুর জেলা। জেলার মোট আয়তন প্রায় ৩,৬৮৬ বর্গ কিলোমিটার (১,৪২৩ বর্গ মাইল প্রায়)।
নোয়াখালীর প্রধান নদীগুলো হলো মেঘনা, গোমতী ও ফেনী। এছাড়াও জেলাটিতে নিঝুম দ্বীপ সহ বেশ কয়েকটি দ্বীপ রয়েছে, যা বাংলাদেশের বৃহত্তম নদী দ্বীপ। নোয়াখালীর অর্থনীতি কৃষি, মাছ ধরা এবং বনায়নের উপর নির্ভরশীল। জেলায় উৎপাদিত প্রধান ফসল ধান, পাট ও শাকসবজি। জেলায় বেশ কিছু মাছ ধরা এবং বনজ শিল্পও রয়েছে। এটি বাংলাদেশের একটি প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। জেলাটিতে লালদীঘি প্রাসাদ, নোয়াখালী জাদুঘর এবং নোয়াখালী জিলা স্কুল সহ অনেক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন রয়েছে।
নোয়াখালী জেলার ইতিহাস
বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার নামটি এসেছে নোয়াখালী শহর থেকে, যেটি ছিল পুরাতন জেলার প্রাক্তন সদর দপ্তর। এটি দুটি শব্দের একটি যৌগ; নোয়া (যার অর্থ নতুন) এবং খালি (খাল অর্থ খালের একটি ক্ষীণ)।
এর নামকরণের পেছনের ইতিহাসটি একটি খাল থেকে পাওয়া যায় যা ১৬৬০-এর দশকে ধ্বংসাত্মক বন্যার প্রতিক্রিয়া হিসাবে খনন করা হয়েছিল যা এলাকার কৃষি কার্যক্রমকে প্রভাবিত করেছিল। এই খালটি ডাকাতিয়া থেকে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা নদী ও ফেনী নদীর সংযোগস্থলে পানি প্রবাহ প্রবাহিত করার জন্য প্রবাহিত হয়েছিল।
নোয়াখালী জেলা ১৮৬৮ সালে ভুলুয়া জেলার নাম পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেটি ব্রিটিশরা ২৯ মার্চ ১৮২২ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিল। মেঘনার ফলে ১৯৫১ সালে শহরটি নদীগর্ভে বিলীন হওয়া পর্যন্ত এর সদর দফতর নোয়াখালী শহরে ছিল। নদী ভাঙন এরপর মাইজদীতে নোয়াখালী জেলার একটি নতুন সদর দপ্তর স্থাপিত হয়।
১৯৬৮ সালে সদর মহকুমাকে দুটি মহকুমায় বিভক্ত করা হয়; নোয়াখালী সদর ও লক্ষ্মীপুর হলেও ফেনী মহকুমা কেমন ছিল। ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য নোয়াখালী জেলাকে আরও তিনটি জেলায় ভাগ করা হয়; নোয়াখালী জেলা, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী।
নোয়াখালী জেলার থানা/উপজেলা সমূহ
জেলাটি ৯টি থানা/উপজেলায় বিভক্ত, যা হলো:
- নোয়াখালী সদর উপজেলা,
- বেগমগঞ্জ উপজেলা,
- চাটখিল উপজেলা,
- কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা,
- হাতিয়া উপজেলা,
- কবিরহাট উপজেলা,
- সেনবাগ উপজেলা,
- সোনাইমুড়ী উপজেলা,
- সুবর্ণচর উপজেলা।
উপজেলাগুলো আবার ইউনিয়ন পরিষদে (স্থানীয় সরকার সংস্থা) বিভক্ত।
এখানে প্রতিটি উপজেলা সম্পর্কে কিছু অতিরিক্ত তথ্য রয়েছে:
নোয়াখালী সদর উপজেলা
নোয়াখালী সদর উপজেলা হল জেলার প্রশাসনিক সদর দফতর। এটি নোয়াখালী নদীর তীরে অবস্থিত এবং এখানে বেশ কয়েকটি সরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বেগমগঞ্জ উপজেলা
বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বেগমগঞ্জ উপজেলা অবস্থিত। এটি বেগমগঞ্জ মসজিদ এবং বেগমগঞ্জ দুর্গ সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানের আবাসস্থল।
চাটখিল উপজেলা
জেলার উত্তর-পশ্চিমে চাটখিল উপজেলা অবস্থিত। এটি অনেকগুলি বন এবং জলাভূমির আবাসস্থল এবং এটি পাখি দেখার জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা
জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা অবস্থিত। এটি কোম্পানীগঞ্জ মসজিদ এবং কোম্পানীগঞ্জ দুর্গ সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানের আবাসস্থল।
হাতিয়া উপজেলা
হাতিয়া উপজেলা বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপে। এটি বেশ কয়েকটি সৈকত এবং রিসর্টের আবাসস্থল এবং এটি পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
কবিরহাট উপজেলা
জেলার দক্ষিণ-পূর্বে কবিরহাট উপজেলা অবস্থিত। এটি কবিরহাট মসজিদ এবং কবিরহাট কেল্লা সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় স্থানের আবাসস্থল।
সেনবাগ উপজেলা
জেলার উত্তর-পূর্বে সেনবাগ উপজেলা অবস্থিত। এটি বেশ কয়েকটি বন এবং জলাভূমির আবাসস্থল এবং এটি পাখি দেখার জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
সোনাইমুড়ী উপজেলা
সোনাইমুড়ী উপজেলা জেলার মধ্যভাগে অবস্থিত। এটি সোনাইমুরি মসজিদ এবং সোনাইমুরি দুর্গ সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় স্থানের আবাসস্থল।
সুবর্ণচর উপজেলা
জেলার উত্তর-মধ্য অংশে সুবর্ণচর উপজেলা অবস্থিত। এটি অনেকগুলি বন এবং জলাভূমির আবাসস্থল এবং এটি পাখি দেখার জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
নোয়াখালী জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ
এখানে নোয়াখালী জেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু পর্যটন কেন্দ্র সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
নিঝুম দ্বীপ
নিঝুম দ্বীপ নোয়াখালী শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীতে অবস্থিত একটি ছোট দ্বীপ। দ্বীপটি ম্যানগ্রোভ বনে আচ্ছাদিত এবং এখানে হেরন, এগ্রেটস এবং ফ্ল্যামিঙ্গো সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বাসস্থান। নিঝুম দ্বীপ পাখি দেখার এবং প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
বজরা শাহী জামে মসজিদ
বজরা শাহী জামে মসজিদ বজরা শহরে অবস্থিত একটি সুন্দর মসজিদ। এটি ১৮ শতকে স্থানীয় ব্যবসায়ী আমান-উল্লাহ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। মসজিদটি মুঘল স্থাপত্যের একটি চমৎকার নিদর্শন এবং এটি জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন।
খৈয়াছড়া জলপ্রপাত
খৈয়াছড়া জলপ্রপাত খৈয়াছড়া উপজেলায় অবস্থিত একটি সুন্দর জলপ্রপাত। জলপ্রপাতটি প্রায় ১০০ ফুট উঁচু এবং চারপাশে সবুজ বনে বেষ্টিত। খৈয়াছড়া জলপ্রপাত পিকনিক এবং হাইকিংয়ের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
পিলাক
পিলক বেগমগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত একটি ছোট গ্রাম। এটি একটি বৌদ্ধ বিহার এবং একটি হিন্দু মন্দির সহ বেশ কয়েকটি প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের আবাসস্থল। ধ্বংসাবশেষ ৭ম শতাব্দীর এবং এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ ইতিহাসের একটি প্রমাণ।
গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট
গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট মহাত্মা গান্ধীকে নিবেদিত একটি স্মারক কমপ্লেক্স। ১৯৪৬ সালে গান্ধী তার নোয়াখালী সফরের সময় যেখানে অবস্থান করেছিলেন সেখানে এটি তৈরি করা হয়েছিল। কমপ্লেক্সটিতে একটি জাদুঘর, একটি গ্রন্থাগার এবং একটি বাগান রয়েছে। গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও কাজ সম্পর্কে জানার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত জায়গা।
নোয়াখালী জেলা পার্ক
নোয়াখালী জেলা উদ্যান, মাইজদী পার্ক নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের নোয়াখালীর মাইজদীতে অবস্থিত একটি পাবলিক পার্ক। এটি জেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলির মধ্যে একটি। পার্কটি ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি প্রায় ১০ একর এলাকা জুড়ে রয়েছে এবং এটি বিভিন্ন গাছ, ফুল এবং গাছপালাগুলির আবাসস্থল। পার্কটিতে একটি খেলার মাঠ, একটি সুইমিং পুল, একটি রেস্তোরাঁ এবং একটি মসজিদ সহ বেশ কয়েকটি সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
নোয়াখালী জেলা পার্ক সব বয়সের মানুষের কাছে একটি জনপ্রিয় স্পট। এটি বিশ্রাম এবং আউটডোর উপভোগ করার জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা। পার্কটি কনসার্ট, উত্সব এবং বিবাহের মতো ইভেন্টগুলির জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।
যে কারণে নোয়াখালী জেলা বিখ্যাত
নোয়াখালী জেলা বিখ্যাত হওয়ার কিছু কারণ এখানে উল্লেখ করা হল:
- নিঝুম দ্বীপ (দ্বীপ): নিঝুম দ্বীপ মেঘনা নদীতে অবস্থিত একটি সুন্দর দ্বীপ। সাদা বালির সৈকত, ম্যানগ্রোভ বন এবং স্বচ্ছ জল সহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য।
- বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন স্মৃতি জাদুঘর: বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন ছিলেন একজন বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা যিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পুরষ্কার বীরশ্রেষ্ঠে ভূষিত হয়েছিলেন। জাদুঘরটি তার জীবন এবং কাজের জন্য উত্সর্গীকৃত।
- মুক্তমঞ্চ: মুক্তমঞ্চ একটি ঐতিহাসিক স্থান যা ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সভার স্থান ছিল। সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত ছিলেন।
- বজরা শাহী মসজিদ: বজরা শাহী মসজিদ একটি সুন্দর মসজিদ যা ১৮ শতকে নির্মিত। এটি নোয়াখালীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান।
- গান্ধী আশ্রম: গান্ধী আশ্রম একটি ঐতিহাসিক স্থান যা ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধী দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য আশ্রমটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।
- নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়: নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একটি নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় যা নোয়াখালীতে অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
নোয়াখালী জেলা একটি সুন্দর এবং ঐতিহাসিক জেলা যেখানে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণ, ঐতিহাসিক স্থান এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।