নাটোর বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের একটি জেলা। এটি দেশের উত্তর অংশে অবস্থিত এবং উত্তরে নওগাঁ ও বগুড়া জেলা, দক্ষিণে পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলা, পূর্বে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে রাজশাহী জেলা দ্বারা সীমাবদ্ধ। নাটোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত সড়কের দূরত্ব প্রায় ২২০ কিলোমিটার। নাটোর কেল্লা, নাটোর প্রাসাদ এবং নাটোর জাদুঘর সহ এই জেলাটি অনেক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থানের আবাসস্থল।
নাটোর একটি কৃষি প্রধান জেলা এবং ধান, গম, শাকসবজি এবং ফল উৎপাদনের জন্য পরিচিত। জেলাটিতে টেক্সটাইল, চিনিকল এবং সার কারখানা সহ বেশ কয়েকটি শিল্পের আবাসস্থল। এর একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ একটি প্রাণবন্ত ও বৈচিত্র্যময় জেলা। এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং এখানে নাটোর সরকারি কলেজ এবং নাটোর মেডিকেল কলেজ সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
নাটোর জেলার ইতিহাস
নাটোর নামটি "নারোদ" শব্দ থেকে এসেছে, একটি নদী যা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। নরোত্তম নামে এক পৌরাণিক ঋষির নামে এই নদীর নামকরণ করা হয়েছিল। জেলাটি মূলত একটি বিল ছিল (একটি বৃহৎ জলাশয়) যাকে বলা হয় ছাইভাঙ্গা। ১৭০৬ সালে রাজা রামজীবন রায়, একজন জমিদার (জমিদার) বিল ভরাট করে এখানে তার রাজধানী স্থাপন করেন। নদীর নামে রাজধানীর নামকরণ করেন নাটোর।
১৭৬৯ থেকে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত নাটোর ছিল রাজশাহী জেলার সদর দপ্তর। ১৮২৫ সালে সদর দপ্তর রাজশাহীতে স্থানান্তরিত হয় এবং নাটোর রাজশাহী জেলার একটি মহকুমায় পরিণত হয়। ১৮৪৫ সালে, নাটোরকে মহকুমা (একটি মহকুমা সদর দপ্তর) ঘোষণা করা হয়। নাটোর শহর ১৮৬৯ সালে একটি পৌরসভায় পরিণত হয়। এক শতাব্দীরও বেশি সময় পরে, ১৯৮৪ সালে, নাটোর মহকুমা স্বাধীন বাংলাদেশে একটি জেলায় পরিণত হয়।
নাটোর জেলার থানা/উপজেলা সমূহ
নাটোর জেলাটি ৭টি থানা/উপজেলা নিয়ে গঠিত যা হলো:
- নাটোর সদর উপজেলা,
- বাগাতিপাড়া উপজেলা,
- সিংড়া উপজেলা,
- বড়াইগ্রাম উপজেলা,
- গুরুদাসপুর উপজেলা,
- লালপুর উপজেলা,
- নলডাঙ্গা উপজেলা।
প্রতিটি উপজেলাকে আবার ইউনিয়ন এবং গ্রাম সমূহে ভাগ করা হয়েছে।
নাটোর জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ
এখানে বাংলাদেশের নাটোর জেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু পর্যটন আকর্ষণ আছে:
নাটোর রয়্যাল প্যালেস
এই প্রাসাদটি ১৮ শতকে রাজা নাটোর নারায়ণ রায় তৈরি করেছিলেন। এটি একটি দোতলা বিল্ডিং যার মাঝখানে একটি উঠান রয়েছে। প্রাসাদটি এখন একটি জাদুঘর যেখানে মুঘল ও ব্রিটিশ যুগের নিদর্শনগুলির একটি সংগ্রহ রয়েছে।
চলন বিল
এটি একটি বৃহৎ জলাভূমি এলাকা যেখানে বিভিন্ন ধরনের পাখি ও প্রাণীর আবাসস্থল। পাখি পর্যবেক্ষন এবং মাছ ধরার জন্য এটি একটি জনপ্রিয় স্থান।
চাপিলা রাজকীয় মসজিদ
এই মসজিদটি ১৭ শতকে রাজা চাপিলা নারায়ণ রায় তৈরি করেছিলেন। এটি মুঘল স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন।
দয়ারামপুর প্রাসাদ
রাজা দয়ারাম রায় ১৯ শতকে এই প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন। এটি একটি দোতলা বিল্ডিং যার মাঝখানে একটি উঠান রয়েছে। প্রাসাদটি এখন একটি ব্যক্তিগত বাসস্থান।
ফকির চাঁদ
এটি বৈষ্ণব গোঁসাইয়্যি সম্প্রদায়ের একটি আশ্রম। এটি হিন্দুদের জন্য একটি জনপ্রিয় তীর্থস্থান।
মারিয়া ধর্মপল্লী
এটি একটি ক্যাথলিক গির্জা যা ১৯ শতকে নির্মিত হয়েছিল। এটি খ্রিস্টানদের একটি জনপ্রিয় তীর্থস্থান।
রানী ভবানী প্রাসাদ
এই প্রাসাদটি ১৮ শতকে রানী ভবানী তৈরি করেছিলেন। এটি একটি দোতলা বিল্ডিং যার মাঝখানে একটি উঠান রয়েছে। প্রাসাদটি এখন একটি জাদুঘর যেখানে মুঘল ও ব্রিটিশ যুগের নিদর্শনগুলির একটি সংগ্রহ রয়েছে।
শহীদ সাগর
এটি ১৯৭০ এর দশকে তৈরি একটি লেক। এটি সাঁতার, বোটিং এবং মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।
নাটোর জেলার অনেক পর্যটন আকর্ষণের মধ্যে এগুলি কয়েকটি মাত্র। এর সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সংস্কৃতির সাথে, নাটোর একটি সপ্তাহান্তে ছুটি কাটাতে বা দীর্ঘ ছুটিতে যাওয়ার জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা।
নাটোর জেলা পার্ক/উদ্যান
নাটোর জেলা উদ্যান বাংলাদেশের নাটোর জেলার নাটোর সদর উপজেলায় অবস্থিত একটি পাবলিক পার্ক। এটি রাজশাহী-বগুড়া মহাসড়কের পাশে, শংকর গোবিন্দ চৌধুরী স্টেডিয়ামের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত। পার্কটি ২০০৬ সালে নাটোরের কালেক্টর, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। পার্কটি নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে সুন্দর ও নতুন করে সাজানো, কিন্তু আজকাল এটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
পার্কটি ১০ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং বিভিন্ন গাছ, ফুল এবং গাছপালা রয়েছে। এটিতে শিশুদের জন্য একটি খেলার মাঠ, একটি ঝর্ণা এবং একটি লেক রয়েছে। নাটোর জেলা পার্ক সব বয়সের মানুষের কাছে একটি জনপ্রিয় স্থান। এটি বিশ্রাম নেওয়ার, হাঁটাহাঁটি করার বা পিকনিক করার জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা। পার্কটি অনুষ্ঠান এবং সমাবেশের জন্যও একটি জনপ্রিয় স্থান।
যে কারনে নাটোর জেলা বিখ্যাত
নাটোর জেলা বিখ্যাত হওয়ার কয়েকটি কারণ এখানে উল্লেখ করা হল:
- রানী ভবানী রাজবাড়ি: রানী ভবানী রাজবাড়ি হল একটি প্রাসাদ কমপ্লেক্স যা ১৭ শতকে রানী ভবানী, একজন শক্তিশালী মহিলা শাসক দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। প্রাসাদটি নাটোর শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।
- চলন বিল: চলন বিল নাটোর জেলার উত্তরে অবস্থিত একটি বৃহৎ জলাভূমি এলাকা। পাখি দেখার জন্য এবং অন্যান্য প্রকৃতির কার্যকলাপের জন্য বিল একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
- দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি: দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি হল একটি প্রাসাদ কমপ্লেক্স যা ১৮ শতকে দিঘাপতিয়া পরিবার, একটি শক্তিশালী জমিদার পরিবার দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। প্রাসাদটি নাটোর জেলার দিঘাপতিয়া উপজেলায় অবস্থিত।
- প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: নাটোর জেলা নদী, বন এবং পাহাড় সহ অনেকগুলি প্রাকৃতিক আকর্ষণের আবাসস্থল। আত্রাই নদী জেলার প্রধান নদী এবং এটি মাছ ধরা এবং নৌকা চালানোর জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। নাটোর পাহাড় জেলার উত্তরে অবস্থিত এবং আশেপাশের গ্রামাঞ্চলের অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখায়।
- কৃষি: নাটোর জেলা একটি প্রধান কৃষি অঞ্চল এবং এটি ধান, আম এবং চিনি উৎপাদনের জন্য পরিচিত। এছাড়াও জেলাটিতে বেশ কিছু পশুসম্পদ খামার রয়েছে।
সামগ্রিকভাবে, নাটোর জেলা একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে একটি প্রাণবন্ত ও বৈচিত্র্যময় অঞ্চল। পর্যটক এবং স্থানীয়দের জন্য এটি একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।