চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের একটি জেলা। এটি দেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত এবং উত্তর ও পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, পূর্বে নওগাঁ জেলা এবং দক্ষিণ-পূর্বে রাজশাহী জেলা দ্বারা সীমাবদ্ধ। জেলার মোট আয়তন ১,৭০৩ বর্গ কিলোমিটার (৬৫৭ বর্গ মাইল)। চাঁপাইনবাবগঞ্জ একটি প্রধানত গ্রামীণ জেলা যেখানে জনসংখ্যা প্রায় ২.২ মিলিয়ন। জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান, তারপরে হিন্দু ও বৌদ্ধরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতি ধান, পাট, গম এবং আখ প্রধান ফসল সহ কৃষির উপর নির্ভরশীল। জেলাটিতে চিনিকল, রাইস মিল এবং পাটকল সহ বেশ কয়েকটি শিল্পের আবাসস্থল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য, যেখানে অনেক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থান রয়েছে। জেলার সবচেয়ে বিখ্যাত পর্যটন আকর্ষণ হল নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সমাধি, যিনি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন। অন্যান্য জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দুর্গ, শিবগঞ্জ মসজিদ এবং নাচোল উপজেলা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ইতিহাস
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামের একটি দীর্ঘ ও আকর্ষণীয় ইতিহাস রয়েছে। জেলাটি মূলত প্রাচীন গৌর রাজধানীর অংশ ছিল এবং বলা হয় যে মহানন্দা ও গঙ্গা নদীর সংযোগস্থলে অবস্থানের কারণে এই অঞ্চলটির কৌশলগত এবং বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল। এর গুরুত্বের কারণে আলীবর্দী খান নওয়াবগঞ্জ শহর প্রতিষ্ঠা করেন যা কালক্রমে নবাবগঞ্জ নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত নবাবগঞ্জ ভারতের মালদা জেলার অধীনে একটি থানা ছিল। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার, মালদা একসময় গৌড়-বঙ্গের রাজধানী ছিল, দিয়ারা এবং বরেন্দ্র হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছিল।
১৯৪৭ সালের ১২ থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে জেলাটি ভারত বা পাকিস্তানের অংশ হবে কিনা তা অজানা ছিল, কারণ র্যাডক্লিফ লাইনের ঘোষণা এই বিন্দুটিকে স্পষ্ট করেনি। এই কয়েক দিনের মধ্যে জেলাটি পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে ছিল যতক্ষণ না র্যাডক্লিফ পুরস্কারের বিবরণ প্রকাশিত হয় এবং জেলাটি ১৭ আগস্ট ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের অংশ হয়ে ওঠে। রাজশাহী জেলার অধীনে পাঁচটি থানা পাকিস্তানকে দেওয়া হয় যা পরবর্তীতে গঠিত হয়। চাঁপাই নবাবগঞ্জ।
‘চাঁপাই নবাবগঞ্জ’ নামটি খুব পুরনো নয়। ২০০১ সালের আগে এটি শুধুমাত্র নবাবগঞ্জ বা নবাবগঞ্জ নামে পরিচিত ছিল। মহানন্দা নদীর তীরে জেলার অবস্থানকে প্রতিফলিত করার জন্য নাম পরিবর্তন করা হয়েছে, যা বাংলায় "চাপাই" নামে পরিচিত।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি সমৃদ্ধ একটি সুন্দর ও ঐতিহাসিক স্থান। এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য, এবং এটি কৃষি, উত্পাদন এবং পর্যটন সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের আবাসস্থল। জেলাটি সড়ক ও রেলপথে সুসংযুক্ত এবং এটি রাজধানী ঢাকা থেকে অল্প দূরে অবস্থিত।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার থানা/উপজেলা সমূহ
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাটি পাঁচটি উপজেলা বা থানায় বিভক্ত:
- চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা,
- গোমস্তাপুর উপজেলা,
- নাচোল উপজেলা,
- শিবগঞ্জ উপজেলা,
- ভোলাহাট উপজেলা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার উত্তরে গোমস্তাপুর উপজেলা অবস্থিত। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার পূর্বে নাচোল উপজেলা অবস্থিত। শিবগঞ্জ উপজেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার দক্ষিণে অবস্থিত। ভোলাহাট উপজেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার পশ্চিমে অবস্থিত। জেলার প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হল কৃষি, গবাদি পশু এবং ক্ষুদ্র শিল্প।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় অনেকগুলো পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
সোনা মসজিদ
এই মসজিদটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম এবং গুরুত্বপূর্ণ মসজিদগুলির মধ্যে একটি। এটি ১৫ তম শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি ইসলামিক স্থাপত্যের একটি চমৎকার উদাহরণ।
দরাসবাড়ী মসজিদ
এই মসজিদটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি ১৭ শতকে নির্মিত হয়েছিল এবং এর সুন্দর পোড়ামাটির সজ্জার জন্য পরিচিত।
খনিয়াদিঘি
এটি একটি বৃহৎ কৃত্রিম হ্রদ যা ১৬ শতকে নির্মিত হয়েছিল। এটি সাঁতার, বোটিং এবং মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।
নওদা বুরুজ
এটি একটি ১৫ শতকের ওয়াচটাওয়ার যা আশেপাশের গ্রামাঞ্চলের অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখায়।
বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সমাধি
এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়াই করা একজন বাংলাদেশী বীর বীরের সমাধি।
খনিয়া দিঘী
এটি একটি বড় পুকুর যা ১৬ শতকে নির্মিত হয়েছিল। এটি পিকনিক এবং মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।
শাহ নিয়ামতুল্লাহ ওয়ালীর সমাধি
এটি ১৬ শতকে বসবাসকারী একজন সুফি সাধকের সমাধি। এটি মুসলমানদের একটি জনপ্রিয় তীর্থস্থান।
শাহ নিয়ামতুল্লাহ মসজিদ
এই মসজিদটি ষোড়শ শতাব্দীতে শাহ নিয়ামতুল্লাহ ওয়ালী নির্মাণ করেন। এটি ইসলামী স্থাপত্যের একটি চমৎকার নিদর্শন।
ধনিয়াচক মসজিদ
এই মসজিদটি ১৭ শতকে নির্মিত। এটি তার সুন্দর পোড়ামাটির সজ্জার জন্য পরিচিত।
শপনোপল্লী
এটি একটি সুন্দর প্রাসাদ যা ১৯ শতকে নির্মিত হয়েছিল। এটি এখন একটি জাদুঘর যেখানে প্রাচীন জিনিসপত্র এবং নিদর্শনগুলির একটি সংগ্রহ রয়েছে৷
নাচোল প্রাসাদ
এটি একটি প্রাসাদ যা ১৮ শতকে নির্মিত হয়েছিল। এটি এখন একটি যাদুঘর যেখানে প্রাচীন জিনিস এবং নিদর্শনগুলির একটি সংগ্রহ রয়েছে৷
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অনেক পর্যটন আকর্ষণের মধ্যে এগুলি কয়েকটি। জেলার একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সংস্কৃতি রয়েছে এবং প্রত্যেকের জন্য উপভোগ করার জন্য কিছু আছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পার্ক সমূহ
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় একটি মাত্র পার্ক আছে, তার নাম সোনা মসজিদ শিশু পার্ক। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শাহাবাজপুরে এটি অবস্থিত। পার্কটি পরিবার এবং শিশুদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য, এবং এটিতে একটি নৌকা স্ট্যান্ড, একটি সুইমিং পুল, স্থাপত্য ভাস্কর্য এবং রাইড সহ বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণ রয়েছে৷ পার্কটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।
যে কারনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিখ্যাত
চাঁপাইনবাবগঞ্জ অনেক কিছুর জন্য বিখ্যাত, যার মধ্যে কয়েকটি হলো:
- আম: চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাংলাদেশের "আমের রাজধানী" হিসাবে পরিচিত এবং এর আম বিশ্বের সেরা কয়েকটি। এই জেলায় ফজলি, ল্যাংড়া, হিমসাগর এবং আম্রপালি সহ বিভিন্ন ধরণের আম উৎপন্ন হয়।
- ঐতিহাসিক স্থান: চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছোট সোনা মসজিদ, দরাশবাড়ী মসজিদ এবং খানিয়া দীঘি মসজিদ সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। এই মসজিদগুলি ৫০০ বছরেরও বেশি পুরানো এবং বাংলাদেশের ইসলামিক স্থাপত্যের সেরা উদাহরণ হিসাবে বিবেচিত।
- প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: চাঁপাইনবাবগঞ্জে চাঁপাই নদী, অজাইপুর বিল এবং নওদা বুরুজ সহ অনেকগুলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান রয়েছে। এই আকর্ষণগুলি দর্শকদের এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ দেয়।
- সংস্কৃতি: চাঁপাইনবাবগঞ্জ একটি সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির আবাসস্থল, যা এর খাবার, সঙ্গীত এবং উৎসবে প্রতিফলিত হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের দর্শনার্থীরা স্থানীয় বাজার, রেস্তোরাঁ এবং উত্সবগুলি ঘুরে এই সংস্কৃতিটি সরাসরি অনুভব করতে পারেন।
সামগ্রিকভাবে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ একটি আকর্ষণীয় এবং বৈচিত্র্যময় জেলা যা সবাইকে দিতে পারে। আপনি ইতিহাস, সংস্কৃতি বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আগ্রহী হোন না কেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আপনি অবশ্যই ভালোবাসার কিছু খুঁজে পাবেন।